বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০১৪

প্রাকৃতিক উপায়ে চুল পরিষ্কার

শ্যাম্পু বা সাবান দিয়ে চুল পরিষ্কার করলে যাদের চুল পড়ে যায় বা এলার্জি হয় তারা প্রাকৃতিক উপায়ে চুল পরিষ্কার করতে পারেন। এতে চুলের ক্ষতিও হবে না এবং চুলও অনেক কম পড়বে। যারা ঘরের বাইরে বেশি যান তারা সপ্তাহে দুদিন অবশ্যই চুল পরিষ্কার করবেন। বাইরের ধুলোবালির জন্যে চুলের গোড়ার লোমকুপগুলো বন্ধ হয়ে যেতে চায়। এতে চুল বেশি পড়ে। যাদের চুল তৈলাক্ত তাদের চুলে ময়লা আটকায় বেশি।মানুষের মুখের ত্বকের মতো চুলেরও বিভিন্ন ধরন আছে; যেমন :

১. তৈলাক্ত চুল
২.রুক্ষ চুল
৩. স্বাভাবিক চুল
তাই আপনার যে ধরনেরই চুল হোক না কেন, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে পরিষ্কার করলে চুলের কোনো ক্ষতি হবে না। রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার করলে তার অনেক বিধি-নিষেধ মানতে হয়, কিন্তু প্রাকৃতিক সামগ্রীর তেমন কোনো বিধি-নিষেধ নেই। এটি একটি বিরাট সুবিধা। এবার জেনে নিন কী কী উপায়ে প্রাকৃতিক শ্যাম্পু বানিয়ে আপনি মাথা পরিষ্কার করতে পারেন।

প্রথম পদ্ধতি
উপকরণ : 
২ চামচ মেথি, ৪টি শুকনো আমলকি (বিচি বাদ দিয়ে), মেহেদি পাতা বাটা ১ টেবিল চামচ, খুসবু করার জন্যে ১ টুকরো সোন্দা ও ১ টুকরো লেবু।

প্রস্ত্তত প্রণালী :
মেথি, আমলকি ও সোন্দা একত্রে ধুয়ে ১ কাপ পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। মনে রাখবেন যে দিন মাথা ধোবেন তার ১ দিন আগেই এগুলো ভেজাতে হবে। মেথি, আমলকি ও সোন্দা ভিজে ফুলে নরম হবে। এবার শিলপাটায় মেথি পিষে নেবেন। মেথি ভেজানো পানি ফেলবেন না। ঐ পানি একত্রে মিশিয়ে নেবেন। এবার একটি পাত্রে বাটা মেহেদি, মেথি, লেবুর পিস থেকে রস নিয়ে একত্র করে চটকে নরম পেস্টের মতো করে নিন। এই পেস্ট চুলে তেল দেয়ার মত বিলি দিয়ে চামড়ায় এবং চুলে ভাল করে লাগিয়ে দু’ঘন্টা রাখবেন। কমপক্ষে ১ ঘন্টা রাখতে হবে। গোসলের সময় প্রথমে মাথায় পানি ঢেলে একটু নরম হলে আস্তে আস্তে ঘষে ঘষে পানি ঝেড়ে মাথা পরিষ্কার করবেন। এই পদ্ধতিতে চুল পরিষ্কার করতে একটু ঝামেলা মনে হলেও চুলের জন্যে বিশেষ উপকারী। মেথি পিচ্ছিল বলে এতে বেশ পানি দিয়ে মাথা পরিস্কার করতে হয়।

তৈলাক্ত চুল হলে গোসলের শেষে ১ পিস লেবুর রস মগে একটু পানির সাথে মিশিয়ে চুলে মেখে নিতে পারেন। এতে চুল যেমন নরম হবে তেমনি চকচকও করবে এবং মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসবে। রুক্ষ্ম, স্বাভাবিক সব চুলেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। চুলের পরিমাণ বুঝে একই অনুপাতে দ্রব্য বাড়িয়ে নিতে পারেন। এই পদ্ধতিতে চুল ধুলে চুলে খুসকি হয় না এবং চুলের গোড়া শক্ত হয়। যারা প্রাকৃতিক উপায়ে চুলে রং করতে চান তারা মেহেদি পাতা বাটা বেশি করে দিলে আস্তে আস্তে কিছুদিন পর লালচে আভা আসবে। মেহেদি পাতার রস চুলের গোড়া শক্ত করে।


রিঠার সাহায্যে চুল ধোয়া


মাথার চুল পরিষ্কার করার কাজে রিঠা ফলের গুরুত্ব আজও অপরিসীম। স্যাপিনডাস প্রজাতির গাছের ফল রিঠা। রিঠা ফল দেখতে দু’ধরনের- বড় ও ছোট। রিঠা ফলের শাঁস সাধারণত পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহৃত হয়। এতে ১২ শতাংশ স্যাপেনিন নামক সাবান জাতীয় ফেনক রয়েছে বলে এটি মাথার চুলকে বেশ পরিষ্কার করে এবং ঝরঝরে রাখে।
রিঠা বীজের তেল সাবান তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। রিঠার নির্যাসের মধ্যে অল্প অল্প থাকায় এটি চুলের কিউটিকলের জন্যে বেশ উপকারী। আগে যখন শ্যাম্পু ছিল না তখন আমাদের মা-দাদীরা এই রিঠা ফল দিয়ে চুল ধোয়ার ফলেই তাদের চুল ঘন কালো আর লম্বা হতো। আজকাল যত রাসায়নিক সামগ্রী আমরা ব্যবহার করছি তত আমাদের চুল ঝরে পড়ছে।
প্রস্ত্তত প্রণালীঃ
কয়েকটি রিঠা ধুয়ে নিয়ে শীল পাটায় ভেঙ্গে ভিতরের বিচি বের করে ফেলুন। এবার চুলায় পরিষ্কার হাড়ি বসিয়ে ১ মগ পরিমাণ পানিতে রিঠার খোসা ছেড়ে ফুটিয়ে নিন। তিন চার মিনিট ফুটানোর পর ঠান্ডা করে হাত দিয়ে চটকে রসটাকে ভাল করে বের করে নিন। মাথাটা একটু ভিজিয়ে নিবেন তারপর এই রিঠার রস দিয়ে আস্তে আস্তে মাথা ঘষতে শুরু করবেন। মাথা ঘষার পর বেশি পানি দিয়ে চুল ধুতে হবে। তা না হলে রিঠার রস চুলে থেকে যাবে এবং চুল একটু আঠা আঠা মনে হবে। বাজারে মনোহারি দোকানে আপনি রিঠা কিনতে পাবেন। এই ফলটি দেখতে ঘন বাদামি ও গোলাকার।

সরিষার খৈল

সরিষা যে কেবলমাত্র আমাদের রান্না-বান্নায় ব্যবহৃত হয় তা নয়; রূপচর্চায়ও এর অবদান অনেকখানি। রূপচর্চা কথাটা এ কারণেই বললাম যে আপনারা হয়ত বলবেন চুলতো স্বাস্থ্যগত কারণেই ধোয়া দরকার, তার আবার রূপচর্চার সাথে সম্পর্ক কি? হ্যাঁ, আজকাল আর চুল শুধু ধুয়েই আমরা ক্লান্ত নই। এখন এটিকে রূপচর্চার অঙ্গ হিসেবেও দেখছি। আমরা যতই সাজগোজ করি না কেন মাথায় তেল চিট চিট চুল দেখলেই তাকে বলি একেবারে গেঁয়ো। চুল ধুয়ে আমরা দেখছি যে চুলটা চিকচিক করছে কিনা কিংবা সিল্কের মত মনে হচ্ছে কি না ইত্যাদি। তারপর রয়েছে নানা ঢং-এ চুল কাটা, বাধা ইত্যাদি। কারণ কেশবতী নারীর রূপই আলাদা।
এবার আসি সরিষার কথায়। বাচ্চা কিংবা যে কোন বয়সের হোক না কেন খাঁটি সরিষার তেল গায়ে মাখা আমাদের দেশে রেওয়াজ আছে। কিন্তু গ্রাম বাংলায় সরিষা খৈল দিয়ে চুল ধোয়ার রেওয়াজ সম্পর্কে আমরা ক’জনই বা জানি। হাতের কাছের সস্তা জিনিস ব্যবহার করেও আমরা চুলকে অনেকখানি স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে পারি। এবার জেনে নিন কিভাবে সরিষা খৈল দিয়ে চুল পরিষ্কার করবেন।
প্রস্ত্তত প্রণালীঃ
প্রথমে কিছুটা সরিষার খৈল একটি বাটিতে নিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন ভাল করে চটকে নিয়ে ছাকুনি দিয়ে ভালভাবে ছেঁকে সে পানি মাথার চুলে ভাল করে মেখে ঘন্টা খানেক রাখুন। তারপর গোসলের সময় মাথা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করুন। বেশি করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিন। তারপর ভালভাবে চুল শুকিয়ে নিন। দেখবেন চুল ঝরঝরে হয়ে বেশ ফুলে উঠেছে। তৈলাক্ত চুল হলে ১ পিস লেবুর রস পানিতে মিশিয়ে চুলে ঢেলে নিতে পারেন। খৈল দিয়ে চুল ধুলে চুলে খুশকি হয় না।

মুশুরের ডালের বেসন

রান্না ঘরের জিনিস দিয়েও আপনি আপনার চুল পরিষ্কার করতে পারেন। বেসন দিয়ে যেমন শরীর পরিষ্কার করতে পারেন, তেমনি চুল পরিষ্কারের কাজেও এর অবদান কম নয়। আমাদের মা-দাদীরা বেসন দিয়ে চুল পরিষ্কার করতেন।
প্রস্ত্তত প্রণালীঃ চুলের পরিমাণে ডাল নিয়ে ধুয়ে একটি পাত্রে পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। তারপর শিলপাটায় বেটে নিন। পানি মিশিয়ে পেস্টের মত করে চুলে বিলি কেটে ঘন্টাখানেক রেখে চুল ভালভাবে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন। ভালভাবে চুল শুকালে অাঁচড়ে ফেলুন। দেখবেন চুলগুলো ঝরঝরে হয়েছে। আপনার যদি গ্রিন্ডিং মেশিন থাকে তবে তাতেও ডাল গুড়ো করে বেসন তৈরি করে নিতে পারেন। বেসনের সাথে পানি মিশিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে মাথায় ব্যবহার করতে পারেন।
চুল ধোয়ার পর কন্ডিশনার হিসেবে লেবু পানি চুলে ঢেলে দিতে পারেন। এতে চুলের খুসকিও দূর হয়। যে কোন ডালের বেসন দিয়েই চুল ধোয়া যায়, তবে মুশুরের ডালের বেসনই সবচেয়ে ভাল।

পেঁয়াজের রস

এক কালে বলা হতো ‘বউ ভালো লাজে, সালুন (তরকারি) ভাল পেঁয়াজে’- একথা হয়ত আমরা অনেকেই জানি। এর সাথে হয়তো আমরা অনেকেই জানি না যে পেঁয়াজের রস চুলের এক মহা উপকারী ওষুধ। চুলের খুসকি দূর করতে পেঁয়াজের রসের জুড়ি নেই। এমনকি পেঁয়াজের রস মাথায় ঘষলে নতুন চুলও গজায়।
প্রস্ত্তত প্রণালী : ছোট পেঁয়াজ কিছু পরিমাণ নিয়ে থেতো করে রস বের করে সম্পূর্ণ মাথায় বিলি কেটে তেল দেয়ার মতো করে ত্বকে ও চুলে রস মেখে নিন। ঘণ্টা খানেক রেখে বেশি করে পানি দিয়ে ভালভাবে পরিষ্কার করে নিন। চুল শুকালে দেখবেন চুলগুলো রেশমের মতো ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। অনেকে গন্ধের জন্যে পেঁয়াজ দিতে চান না। কিন্তু চুলের জন্যে পেঁয়াজ এক মহৌষধ। মাথা ধোয়ার শেষে পানির সাথে সুগন্ধি কিছু মিশিয়ে নিয়ে মাথায় ঢেলে নিতে পারেন। যেমন, এক মগ পানিতে সরবতি লেবুর ২ টুকরো নিয়ে চিপে রসটা পানিতে মিশিয়ে মাথা ধোয়ার পর সমস্ত চুল লেবু পানি দিয়ে ধুয়ে দিলে সরবতি লেবুর খুসবু আসবে। সেন্টের মতো। আর যারা কৃত্রিম উপায়ে শ্যাম্পু দিয়ে ধুতে চান তারা চুলের উপযোগী শ্যাম্পু দিয়ে ধোবেন।

তেঁতুলের ক্বাথ

আপনার চুলের পরিমাণ মতো তেঁতুল নিয়ে ১টি বাটিতে পানির সাথে মিশিয়ে ঘন পেস্টের মতো বানিয়ে মাথায় বিলিকেটে ১০/১৫ মিনিট রেখে ভাল করে মাথা ধুয়ে নিলে দেখবেন চুলগুলো শুকানোর পরে কেমন ফুরফুরে, নরম ও সিল্কি হয়েছে।
যাদের অন্য কিছু স্যুট করে না তারা তেঁতুল দিয়ে চুল ধুলে উপকৃত হবেন এবং চুলও ছিড়বে না। চুলে কন্ডিশনার হিসেবে কিছু ব্যবহার করতে হবে না।

সব ধরনের চুলের যত্নে করণীয়ঃ
১. সব সময় চিরুনী, ব্রাশ পরিষ্কার রাখবেন।
২. অন্যের চিরুনী, ব্রাশ ব্যবহার করবেন না।
৩. খুব ঘন ঘন চুল ছাটবেন না। অন্ততপক্ষে ১ মাস বা দেড় মাস অন্তর ছাটবেন।
৪. চুলের আগা ফাটলে ছেটে ফেলবেন।
৫. চুল খুব শক্ত কিংবা টান টান করে বাঁধবেন না।
৬. চুলে রাসায়নিক দ্রব্য পারত পক্ষে ব্যবহার করবেন না।
৭. অন্ততপক্ষে সপ্তাহে দুদিন চুলে তেল মালিশ করবেন।
৮. অতিরিক্ত সূর্যের আলো চুলের জন্যে খারাপ। তাই এর হাত থেকে চুলকে রক্ষা করবেন।
৯. বাইরে থেকে এসে চুল ব্রাশ করবেন যাতে ধুলোবালি জমতে না পারে।
১০. খাবারের সাথে ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ও প্রোটিন রাখবেন এতে চুলের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে এবং চুল অকালে পাকবে না।
১১. ছোট মাছ খাবেন।
১২. সর্বোপরি জাজিন বা বজ্রাসনে বসে ছোট বেলা থেকে প্রতিদিন ১০০ বার চুল ব্রাশ করলে চুল অকালে পাকবে না। চুলে খুশকি হবে না।
মেঘ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন